Header Ads

Seo Services

চাষার দুক্ষু (বাংলা ১ম পএ)

লেখক পরিচিতি
রোকেয়া সাখাওয়াত হেসেন ১৮৮০ সালের ৯ই ডিসেম্বর রংপুর জেলার মিঠাপুকুর থানার অর্ন্তগত পারাবন্দ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম জহিরউদ্দীন আবু আলী হায়দার সাবের এবং মাতা রাহাতুন্নেসা চৌধুরী। তাঁর প্রকৃত নাম রোকেয়া খাতুন এবং বৈবাবিক সূত্রে নাম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। রোকেয়ার পিতা বহু ভাষায় সুপণ্ডিত হলেও মেয়েদের শিক্ষার ব্যাপারে ছিলেন রক্ষণশীল। বড় ভাইবোনের সহচর্যে রোকেয়া বাংলা ও ইংরেজি ভাষা ভালোভাবেই রপ্ত করেন এবং জ্ঞানার্জনের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেন। ষোলো বছর বয়সে উর্দুভাষী ও বিপত্মীক সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে (১৮৯৮) তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট স্বামীর উৎসাহ ও অনুপ্রেরণায় তাঁর জ্ঞানার্জনের পথ সুগম হয়। বিরূপ সমালোচনা ও নানাবিধি প্রতিবন্ধকতার মুখেও তিনি কখনোই নারীশিক্ষার লক্ষ থেকে সরে আসেননি, বরং পর্দাপ্রথা ও শিক্ষাবিমুখ মুসলমান মেয়েদের শিক্ষার আলোয় আলোকিত করার জন্য বাড়িতে বাড়িতে ছাত্রী সংগ্রহ করেছেন। রোকেয়া বাংলা গদ্যের বিশিষ্ট শিল্পি। সমাজের কুসংস্কার ও জড়তা দূর করার জন্য তিনি অসাধারণ পাণ্ডিত্বপূর্ণ ও হৃদয়গ্রাহী গদ্য রচনা করেন। তাঁর সব রচনাই সমাজ জীবনের গভীর উপলদ্ধি থেকে উৎসারিত। ‘মতিচুর’ ও ‘অবোরোধবাসিনী’ তাঁর তাৎপর্যপূর্ণ গদ্যগ্রন্থ। এছাড়া ‘সুলতানার স্বপ্ন’ ও ‘পদ্মরাগ’ নামে দুটি উপন্যাসও তিনি রচনা করেন।

১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের ৯ই ডিসেম্বর এই মহীয়সী নারীর জীবনাবাসন ঘটে।

মূলরচনা-১
ক্ষেতে ক্ষেতে পুইড়া মরি রে ভাই

পাছায় জোটে না ত্যানা।

বৌ এর পৈছা বিকায় তবু

ছেইলা পায় না দানা।

শুনিতে পাই, দেড় শত বছর পূর্বে ভারতবাসী অসভ্য বর্বর ছিল। এই দেড়শত বছর হইতে আমরা ক্রমশ সভ্য হইতে সভ্যতর হইতেছি। শিক্ষায়, সম্পদে আমরা পৃথিবীর অন্যান্য দেশে ও জাতির সমকক্ষ হইতে চলিয়াছি। এখন আমাদের সভ্যতা ও ঐশ্বর্য রাখিবার স্থান নাই। সত্যই তো, এই যে অভ্রভেদী পাঁচতলা পাকা বাড়ি, রেলওয়ে, ট্রামওয়ে, স্টিমার, এরোপ্লেন, মোটর লরি, টেলিফোন, টেলিগ্রাফ, পোস্টঅফিস, চিঠিপত্রের সুনিয়মিত ডেলিভারি, এখানে পাটকল, সেখানে চটকল, অট্টালিকার চূড়ায় বড় বড় ঘড়ি, সামান্য অসুখ হইলে আট দশ জন ডাক্তারে টেপে নারী, চিকিৎসা, ঔষধ, অপারেশন, ব্যবস্থাপত্রের ছড়াছড়ি, থিয়েটার, বায়স্কোপ, ঘৌড়দৌড় জনতার হুড়াহুড়ি লেমলেন্ড জিঞ্জারেন্ড, বরফের গাড়ি, ইলেকট্রিক লাইট, ফ্যান, অনারেবলের গড়াগড়ি (বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় খাদ্যদ্রব্যে ভেজালের বাড়াবাড়ি)-এসব কি সভ্যতার নিদর্শন নহে? নিশ্চয়! যে বলে ‘নহে’, সে ডাহা নিমকহারাম।

কিন্তু ইহার অপর পৃষ্ঠাও আছে-কেবল কলিকাতাটুকু আমাদের গোটা ভারতবর্ষ নহে এবং মুষ্টিমেয়, সৌভাগ্যশালী ধনাঢ্য ব্যক্তি সমস্ত ভারতের অধিবাসী নহে। অদ্য আমাদের আলোচ্য বিষয়, চাষার দারিদ্র। চাষাই সমাজের মেরুদণ্ড। তবে আমার ‘ধান ভানিতে শিবের গান’ কেন? অবশ্যই ইহার কারন আছে। আমি যদি প্রথমেই পল্লিবাসী কৃষকের দুঃখ-দুর্দশার কান্না কাঁদিতে বসিতাম তবে কেহ চট্ করিয়া আমার চক্ষে আঙুল দিয়া দেখাইতেন যে, আমাদের মোটরকার আছে, গ্রামোফোন আছে ইত্যাদি। ভালোর ভাগ ছাড়িয়া কেবল মন্দের দিকটা দেখা কেন? সেই জন্য ভালোর দিকটা আগে দেখাইলাম। এখন মন্দের দিকে দেখা যাউক।

ঐ যে চটকল আর পাটকল;-এক একটা জুট মিলের কর্মচারীগণ মাসিক ৫০০-৭০০ (পাঁচ কিম্বা সাত শত) টাকা বেতন পাইয়া নবাবী হালে থাকে, নবাবী চাল চালে, কিন্তু সেই জুট (পাট) যাহারা উৎপাদন করে তাহাদের অবস্থা এই যে,- ‘পাছায় জোটে না ত্যানা!’ ইহা ভাবিবার বিষয় নহে কি? আল্লাহতালা এত অবিচার কিরুপে সহ্য করিতেছেন?

মূলরচনা-২
সমগ্র ভারতের বিষয় ছাড়িয়া কেবল বঙ্গদেশের আলোচনা করিলেই যথেষ্ট হইবে। একটি চাউল পরীক্ষা করিলেই হাড়িভরা ভাতের অবস্থা জানা যায়। আমাদের বঙ্গভূমি সুজলা, সুফলা, শস্য-শ্যামলা,-তবু চাষার উদরে অন্য নাই কেন? ইহার উত্তর শ্রদ্ধাস্পদ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দিয়াছেন, “ধান্য তার বসুন্ধরা যার”। তাইতো অভাগা চাষা কে? সে কেবল “ক্ষেতে ক্ষেতে পুইড়া মরিবে”, হাল বহন করিবে, আর পাট উৎপাদন করিবে। তাহা হইলে চাষার ঘরে যে “মোরাইভরা ধান ছিল, গোয়াল ভরা গরু ছিল, উঠান ভরা মুরগি ছিল”, এ কথার অর্থ কি? এহা কি সুধুই কবির কল্পনা? না, করিব কল্পনা নহে, কাব্য উপন্যাসেও নহে, সত্য কথা। পূর্বে ওসব ছিল এখন নাই। আরে এখন যে আমরা সভ্য হইয়াছি! ইহাই কি সভ্যতা? সভ্যতা কি করিবে, ইউরোপের মহাযুদ্ধ সমস্ত পৃথিবীকে সর্বস্বান্ত করিয়াছে, তা বঙ্গীয় কৃষকের কথা কি?

আমি উপযুক্ত উত্তরে সন্তুষ্ট হইতে পারি না, কারণ ইউরোপীয় মহাযুদ্ধ তো এই সাত বৎসরের ঘটনা। ৫০ বৎসর পূর্বেও কি চাষার অবস্থা ভালো ছিল? দুই একটি উদাহরণ দেখাই-বাল্যকালে শুনিতাম, টাকায় আট সের সরিষার তৈল ছিল আর টাকায় ৪ সের ঘৃত। যখন টাকায় ৮ সের সরিষার তৈল ছিল, তখনকার একটা গল্প এই:

“কৃষক কন্যা জমিরনের মাথায় বেশ ঘন ও লম্বা চুল ছিল, তার মাথায় প্রায় আধ পোয়াটাক তেল লাগিত। সেই জন্য যেদিন জমিরণ মাথা ঘষিত, সেইদিন তাহার মা তাকে রাজবাড়ী লইয়া আসিত, আমরা তাকে তেল দিতাম” হা অদৃষ্ট! যখন দুই গণ্ডা পয়সায় এক সের তৈল পওয়া যাইত, তখনও জমিরনের মাতা কণ্যার জন্য এক পয়সার তেল জুটাইতে পারিত না।

এই তো ৩০/৩৫ বৎসর পূর্বে বিহার অঞ্চলে দুই সের খেসারি বিনিময়ে কৃষক পত্নী কন্যা বিক্রয় করিত। পঁচিশ বৎসর পূর্বে উড়িষ্যার অন্তর্গত কনিকা রাজ্যের অবস্থা এই ছিল যে, কৃষকেরা ‘পখাল (পান্তা) ভাতের সহিত লবণ ব্যতীত অন্য কোন উপকরনের সংগ্রহ করিতে পারিত না। শুটকি মাছ পরম উপাদেয় ব্যঞ্জন বলিয়া পরিগনিত হইত। তখন সেখানে টাকায় ২৫/২৬ সের চাউল ছিল। সাত ভায়া নামক সমুদ্র-তীরবর্তী গ্রামের লোকেরা পখাল ভাতের সহিত লবণও জুটাইতে পারিত না। তাহারা সমুদ্র জলে চাল ধুইয়া ভাত রাধিয়া খাইত। রংপুর জেলার কোন এক গ্রামের কৃষক এত দরিদ্র যে, টাকায় ২৫ সের চাউল পাওয়া সত্বেও ভাত না পাইয়া লাউ, কুমড়া প্রভৃতি তরকারি ও পাটশাক, লাউশাক ইত্যাদি সিদ্ধ করিয়া খাইত। আর পরিধান করিত কি, শুনিবেন? পুরুষেরা বহু কষ্টে স্ত্রীলোকদের জন্য ৮ হাত কিংবা ৯ হাত কাপড় সংগ্রহ করিয়া দিয়া নিজেরা কৌপিন ধারণ করিত। শীতকালে দিবাভাগে মাঠে মাঠে রৌদ্রে যাপন করিত; রাত্রিকালে শীত অসহ্য বোধ হইলে মাঝে মাঝে উঠিয়া পাটখড়ি জ্বালিয়া আগুন পোহাইত। বিচালি (বা পোয়াল খড়) শয্যায় শয়ন করিত। অথচ এই রংপুর ধান্য ও পাটের জন্য প্রসিদ্ধ। সুতরাং দেখা যায়, ইউরোপীয় মহাযুদ্ধের সহিত চাষার দারিদ্রের সম্পর্ক অল্পই। যখন টাকায় ২৫ সের চাউল ছিল, তখনও তারা পেট ভরিয়া খাইতে পায় নাই, এখন টাকায় ৩/৪ সের চাউল হওয়ায়ও তাহারা অর্ধানশনে থাকে-

এ কঠোর মহীতে

চাষা এসেছে শুধু সহিতে;

আর মরমের ব্যথা লুকায়ে মরমে

জঠর-অনলে দহিতে।

মূলরচনা-৩
পঁচিশ, ত্রিশ বৎসর পূর্বের চিত্র তো এই, তবে “মরাই ভরা ধান ছিল, গোয়াল ভরা গরু ছিল, ঢাকা মসলিন কাপড় ছিল” ইত্যাদি কোন সময়ের অবস্থা? মনে হয়, অন্তত শতাধিক বছর পূর্বের অবস্থা। যখন-কৃষক রমণী স্বহস্তে চরকায় সুতা কাটিয়া বাড়িসুদ্ধ সকলের জন্য কাপড় প্রস্তুত করিত। আসাম এবং রংপুর জেলায় একপ্রকার রেশম হয়, স্থানীয় ভাষায় তাহাকে ‘এন্ডি’ বলে। এন্ডি রেশনের পোকা প্রতিপালন ও তাহার গুটি হইতে সুতা কাটা অতি সহজসাধ্য কার্য। এই শিল্প তদ্দেশবাসিনী রমণীদের একচেটিয়া ছিল। তাহারা এ উহার বাড়ি দেখা করিতে যাইবার সময় টেকো হাতে লইয়া সুতা কাটিতে কাটিতে বেড়াইতে যাইত। এন্ডি কাপড় বেশ গরম ও দীর্ঘকাল স্থায়ী হয়। ইহা ফ্লানেল হইতে কোন অংশে ন্যূন নহে, অথচ ফ্লানেল অপেক্ষা দীর্ঘস্থায়ী। একখানি এন্ডি কাপড় অবাধে ৪০ (চল্লিশ) বৎসর টেকে। ৪/৫ খানি এন্ডি চাদর থাকিলে লেপ, কম্বল, কাঁথা কিছুই প্রয়োজন হয় না। ফলকথা, সেকালে রমণীগণ হাসিয়া খেলিয়া বস্ত্র-সমস্যা পূরণ করিত। সুতরাং তখন চাষা অন্য বস্ত্রের কাঙাল ছিল না। তখন কিন্তু সে অসভ্য বর্বর ছিল। এখন তাহারা সভ্য হইয়াছে, তাই-

শিরে দিয়ে বাঁকা তাজ

ঢেকে রাখে টাক্।

কিন্তু তাহাদের পেটে নাই ভাত। প্রশ্ন হইতে পারে-সভ্যতার সহিত দারিদ্র বৃদ্ধি হইবার কারণ কি? কারণ-যেহেতু আপাত সূলভ মূলে বিবিধ রঙিন ও মিহি কাপড় পাওয়া যায়, তবে আর চঙি রকা লইয়া ঘর্ঘও করিবে কেন? বিচিত্র বর্ণের জুট ফ্লানেল থাকিতে বর্ণহীন এন্ডি বস্ত্র ব্যবহার করিবে কেন? পূর্বে পল্লিবাসীগণ ক্ষার প্রস্তুত করিয়া কাপড় কাচিত; এখন তাহাদের কাপড় ধুইবার জন্য হয় ধোপার প্রয়োজন, নয় সোডা। চারি পয়সায় সোডার যে কার্য সিদ্ধ হয়, তাহার জন্য আর কষ্ট করিয়া ক্ষার প্রস্তুত করিবে কেন? এইরূপে বিলাসিতা শিরায় শিরায়, ধমনীতে ধমনীতে প্রবেশ করিয়া তাহাদিগকে বিষে জর্জরিত করিয়া ফেলিয়াছে। ঐ যে “পাছায় জোটে না ত্যানা” কিন্তু মাথায় ছাতা এবং সম্ভবত পায়ে জুতা আছে ত! “বৌ-এর পৈছা বিকায়” কিন্তু তবু “বেলোয়ারের চুড়ি” থাকে ত! মুটে মজুর ট্রাম না হইলে দুই পদ নড়িতে পারে না। প্রথম দৃষ্টিতে ট্রামের ভাড়া পাঁচটা পয়সা অতি সামান্য বেধ হয়-কিন্তু ঐ যাঃ, যাইতে আসিতে দশ পয়সা লাগিয়া গেল! এইরূপ দুইটি পয়সা, চারি পয়সা করিয়া ধীরে ধীরে সর্বস্বহারা হইয়া পড়িতেছে।

নিজ অন্ন পর কর পণ্যে দিলে,

পরিবর্ত ধনে দুরভিক্ষ নিলে!

বিলাসিতা ওরফে সভ্যতার সঙ্গে সঙ্গে ‘অণুকরণপ্রিয়তা’ নামক আরেকটা ভূত তাহাদের স্কন্ধে চাপিয়া আছে। তাহাদের আর্থিক অবস্থা সামান্য একটু সচ্ছল হইলেই তাহারা প্রতিবেশী বড়লোকদের অনুকরণ করিয়া থাকে। তখন চাষার বৌ-ঝির যাতায়াতের জন্য সওয়ারি চাই; ধান ভানাবার জন্য ভারানি চাই, ইত্যাদি। এইরুপ ভূরি ভূরি দৃষ্টান্ত আছে:

সর্ব অঙ্গেই ব্যথা,

ঔষধ দিব কোথা?

আর-

এ বহ্নির শত শিখা

কে করিবে গণনা?

মূলরচনা-৪
অতঃপর শিবিকাবাহকগণ পাল্কি লইয়া ট্রামে যাতায়াত করিলেই সভ্যতার চূড়ান্ত হইবে।

আবার মজা দেখুন, আমরা তো সুসভ্য হইয়া এন্ডি কাপড় পরিত্যাগ করিয়াছি, কিন্তু ঐ এন্ডি কাপড়ই ‘আসাম সিল্ক নামে অভিহিত হইয়া কোট, প্যান্ট ও স্কার্ট রূপে ইউরোপীয় নর-নারীদের বর-অঙ্গে শোভা পাইতে লাগিল! ক্রমে পল্লিবাসিনীর সভ্যতার মাত্রাধিক্য হওয়ায় (অথার্থ আর এন্ডি পোকা প্রতিপালন করা হয় না বলিয়া) এখন আর ‘হোয়াইট এ্যাওয়ে লেডল’র দোকানে ‘আসাম সিল্ক’ পাওয়া যায় না। কেবল ইহাই নহে, আসাম হইতে এন্ডি গুটি বিদেশে চালান যায়-তথা হইতে সূত্র রূপে আবার আসামে ফিরিয়া আইসে। এ তো সেদিনের কথা,-বঙ্গের গভর্নরও লর্ড কারমাইকেল একখানি দেশি রেশমি রুমালের জন্মস্থান অনুসন্ধান করেন, কেহই বলিতে পারিল না সেরুপ রুমাল কোথায় প্রস্তুত হয়। কিন্তু লর্ড কারমাইকেল ইংরেজ বাচ্চা-সহজে ছাড়িবার পাত্র নহেন; তিনি রুমালটার জন্মভূমি আবিষ্কার করিয়া ফেলিলেন। পূর্বে মুর্শিদাবাদের কোন গ্রামে ঐরূপ রেশমি রুমাল প্রস্তুত হইত, এখন আর হয় না, কারণ সে গ্রামের লোকেরা সুসভ্য হইয়াছে! ফল কথা, সভ্যতা বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে দেশি শিল্পসমূহ ক্রমশ বিলুপ্ত হইয়াছে।

সুখের বিষয়, সম্প্রতি পল্লিগ্রামের দুর্গতির প্রতি দেশবন্ধু নেতৃবৃন্দের দৃষ্টি পড়িয়াছে। কেবল দৃষ্টিপাতেই যথেষ্ট নহে, চাষার দুক্ষু যাহাতে দূর হয়, সেজন্য তাঁহাদিগকে বিশেষ চেষ্টা যত্ন করিতে হইবে। আবার সেই “মরাইভরা ধান, ঢাকা মসলিন” ইত্যাদি লাভ করিবার একমাত্র উপায় দেশি শিল্প-বিশেষত নারী শিল্পসমূহের পুনরুদ্ধার। জেলায় জেলায় পাটের চাষ কম করিয়া তৎপরিবর্তে কার্পাসের চাষ প্রচুর পরিমাণে হওয়া চাই এবং চরকা ও এন্ডি সুতার প্রচলন বহুল পরিমাণে হওয়া বাঞ্চনীয়। আসাম এবং রংপুর বাসিনী ললনাগন এন্ডি পোকা প্রতিপালনে তৎপর হইলে সমগ্র বঙ্গদেশের বস্ত্রক্লেশ লাঘব হইবে। পল্লিগ্রামে সুশিক্ষা বিস্তারের চেষ্টা হওয়া চাই। গ্রামে গ্রামে পাঠশালা আর ঘরে ঘরে চরকা ও টেকো হইলে চাষার দারিদ্র ঘুচিবে।

শব্দার্থ ও টীকা
– ছেইলা-ছেলে। সন্তান সন্ততি অর্থে।

– পৈছা-স্ত্রীলোকদের মণিবন্ধনের প্রাচীন অলঙ্কার।

– দানা-খাদ্য অর্থে। ছোলা, মটর, কলাই-এইসব শস্যকেও দানা বলে।

– অভ্রভেদী-অভ্র অর্থ আকাশ বা মেঘ ভেদকারী। আকাশচুম্বী।

– ট্রামওয়ে-ট্রাম চলাচলের রাস্তা। রেলওয়ের মত রাস্তা দিয়ে ট্রাম চলে তবে তা অধিকতর হালকা।

  বাস চলাচলের রাস্তার ভিতরেও ট্রামওয়ে থাকতে পারে।

– বায়স্কোপ-চলচ্চিত্র, ছায়াছবি, সিনেমা।

– চাষাই সমাজের মেরুদণ্ড-বাংলা কৃষিপ্রধান দেশ। সুপ্রাচীন কাল থেকে অন্য কুটির শিল্পের মতো

সামান্য বৃত্তি থাকলেও কৃষিই এদেশের মনুষের জীবনযাপনের প্রধান বৃত্তি। এমন কি বিশ শতকে পৃথিবীর কিছু দেশ যখন শিল্পে আসাধারণ সমৃদ্ধি লাভ করেছে আমাদের দেশ তখনও কৃষি বিকাশকেই সবচেয়ে প্রাধান্য দিয়েছে। সুতরাং কৃষি যে এদেশের মেরুদণ্ড-এ বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই।

– পাছায় জোটে না ত্যানা-পাট উৎপাদনকারী কৃষকদের চরম দারিদ্রের পরিচয় দিতে গিয়ে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনই প্রবাদটি ব্যবহার করেছেন। চটকল প্রতিষ্ঠার পর পাটের চাহিদা ও কদর বেড়ে যায়। পাটকল শ্রমিকগণ পর্যাপ্ত মাসোহারা স্বাচ্ছন্দে জীবনযাপন করতে থাকেন। কিন্তু যারা পাট উৎপাদন করতেন সেই কৃষকদের অবস্থা ছিল মানবেতর। দারিদ্রের সঙ্গে যুঝতে যুঝতে তাদের জীবন শেষ হতো। প্রবাদটির ভিতর দিয়ে কৃষকদের সেই করুণ অবস্থার পরিচয় পাওয়া যায়।

– কৌপিন-ল্যাঙ্গট। চীরবসন। লজ্জা নিবারনের জন্য পরিধেয় সামান্য বস্ত্র।

– মহীতে-পৃথিবীতে।

– টোকা-সুতা পাকাবার যন্ত্র।

– এন্ডি-মোটা রেশমি কাপড়।

– বেলোয়ারের চুড়ি-উৎকৃষ্ট স্বচ্ছ কাচে প্রস্তুত চুড়ি।

পাঠ পরিচিতি
রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন রচিত ‘চাষার দুক্ষু’ শীর্ষক রচনাটি বাংলা একাডেমি প্রকাশিত “রোকেয়া রচনাবলি” থেকে চয়ন করা হয়েছে। তাঁর শিক্ষা ও সামাজিক কর্মকাণ্ড থেকে শুরু করে লেখালেখির জগৎ উৎসর্গীকৃত হয়েছে পশ্চাৎপদ নারীসমাজের মুক্তি ও সমৃদ্ধির জন্য। কিন্তু ‘চাষার দুক্ষু’ শীর্ষক প্রবন্ধটি তৎকালীন দারিদ্র্যপীড়িত কৃষকদের বঞ্চনার মর্মন্তুদ দলিল হয়ে আছে। ভারতবর্ষের সভ্যতা ও অগ্রগতির ফিরিস্তি তুলে ধরে তিনি দেখিয়েছেন, সেখানে কৃষকদের অবস্থা কত শোচনীয়। পাকা বাড়ি, রেলওয়ে, ট্রামওয়ে, স্টিমার, এরোপ্লেন, মোটর গাড়ি, টেলিফোন, টেলিগ্রাফসহ আরও যে কত আবিষ্কার ভারতবর্ষের শহুরে মানুষের জীবন সমৃদ্ধ ও সচ্ছল করে তুলেছে তার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু সেই ভারতবর্ষেই কৃষকদের পেটে খাদ্য জোটে না, শীতে বস্ত্র নেই, অসুখে চিকিৎসা নেই। এমনকি তাদের পান্তাভাতে লবণও জোটে না। সমুদ্র তীরবর্তী লোকেরা সমুদ্রজলে চাল ধুইয়ে লবণের অভাব মেটানোর চেষ্টা করে। টাকায় পঁচিশ সের চাল মিললেও রংপুরের কৃষকগণ চাল কিনতে না পেরে লাউ, কুমড়া, পাট শাক, লাউ শাক সিদ্ধ করে খেয়ে জঠর-যন্ত্রণা নিবারণ করে। কৃষকদের এই চরম দারিদ্র্যের জন্য তিনি সভ্যতার নামে এক শ্রেণির মানুষের বিলাসিতাকে দায়ী করেছেন। আবার কোনো কোনো কৃষককেও এই বিলাসিতার বিষে আক্রান্ত করেছে। এছাড়া গ্রামীণ কুটির শিল্পের বিপর্যয়ও কৃষকদের দারিদ্র্যের অন্যতম কারণ। কুটির শিল্পকে ধ্বংস করে দিয়ে আত্মনির্ভরশীল গ্রাম-সমাজকে চরম সংকটের মধ্যে ফেলেছে ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী। কৃষকদের এই মুমূর্ষু অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন গ্রামে গ্রামে পাঠশালা প্রতিষ্ঠার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। আর গ্রামীণ কুটির শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখারও পরামর্শ দিয়েছেন। এই প্রবন্ধে রোকেয়ার অসাধারণ পাণ্ডিত্য, যুক্তিশীলতা ও চিন্তার বিস্ময়কর অগ্রসরতার প্রতিফলন ঘটেছে।

No comments:

Powered by Blogger.